প্রকাশিত: ১৩/০৪/২০১৭ ৭:১৩ এএম

উখিয়া নিউজ ডেস্ক::

ভীষণ ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন টিনটিন রাখাইন। একদিকে চাকরি, অন্যদিকে নববর্ষের কেনাকাটা। কোনদিক সামাল দেবেন তিনি। তবু বড় নাতি ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র ওয়েহ্লাইন রাখাইনের জন্য প্যান্ট-গেঞ্জি এবং ছোট নাতনি শিশু শ্রেণির চেলির জন্য ফ্রক-প্যান্ট কিনেছেন। সেই সাথে মেয়ের জামাই ও স্বামীর জন্য কিনেছেন শার্ট। কক্সবাজারে পর্যটন করপোরেশনের ইউনিট ম্যানেজার টিনটিন রাখাইন মোটেল প্রবালে কর্মরত। পর্যটক সেবায় দিনের পুরোটা পার হয়ে যায় তাঁর। এরই মধ্যে রাখাইন নববর্ষ কড়া নাড়ছে দরজায়। আগামীকাল বৃহস্পতিবার শুরু হচ্ছে নববর্ষের সপ্তাহব্যাপী অনুষ্ঠান। এ জন্য টিনটিনকে অফিস ছুটির পরই ছুটতে হচ্ছে নববর্ষের কেনাকাটায়।

এখনো অবশ্য নিজের এবং মেয়ের  জন্য কেনাকাটা বাকি। টিনটিন জানালেন, নববর্ষ উপলক্ষে মিয়ানমার থেকে নতুন ডিজাইনের কাপড়-চোপড় আসতে বিলম্বের কারণে এবার কিনতে দেরি হয়েছে একটু। উৎসবের আগের দিন কিনব একটি বার্মিজ থামি ও টপস। মেয়ের জন্যও তাই নেব। আগামীকাল বৃহস্পতিবার থেকে ১৯ এপ্রিল পর্যন্ত রাখাইন নববর্ষের উৎসব চলবে কক্সবাজারে। এখনো সংসারের টুকিটাকি কাজ বাকি। তাঁর মেয়েই ঘরের প্রাথমিক কাজগুলো গুছিয়ে নিয়েছেন। ঘরের পর্দা, বেডশিট, সোফা চেয়ারের বেডকভার থেকে শুরু করে সব কাপড়-চোপড় ধুয়ে নিতে হচ্ছে নববর্ষের আগেই। ঘরের মেঝ থেকে শুরু করে সবকিছুই পানিতে ধুয়ে-মুছে ঝকঝক করা হচ্ছে।

কক্সবাজারের রাখাইন পল্লীতে ইতিমধ্যে নববর্ষের ছোঁয়া লেগেছে। রাখাইন পল্লী সাজছে নতুন সাজে। মাতৃতান্ত্রিক রাখাইন সামাজিকতায় নারীরাই সংসারের খুঁটিনাটি থেকে শুরু করে প্রায় সবকিছুর তদারকি করে থাকেন। রাখাইন নারীরা এখন বড্ড ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। ঘরের কেনাকাটা থেকে শুরু করে পিঠাপুুলি তৈরি সবই দেখার দায়িত্ব পড়ে রাখাইন পরিবারের নারী গৃহকত্রীর ওপর। নারীরাই মূলত সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন-এবারের নববর্ষে ঘরে কী আয়োজন থাকবে সেটা। তাঁরাই সাধ্যমতো চেষ্টা করেন পরিবারের সবাইকে খুশি করার পাশাপাশি পড়শীদেরও কে কত বেশি সমাদর করতে পারেন। নববর্ষ উপলক্ষে প্রেমিক-প্রেমিকাদের মধ্যেও উপহার সামগ্রী দেওয়া-নেওয়া চলে। স্বামী-স্ত্রীও একে অপরকে উপহার দিয়ে থাকেন।

কক্সবাজার শহরের বড়বাজার এলাকার রাখাইন পল্লীর বাসিন্দা রাখাইন নেতা অংকিউচিং বলেন, ‘এ রকম রেওয়াজ পরিবারকে আরো বেশি আবদ্ধ করে রাখে। আমি নিজেও আমার স্ত্রীর জন্য এবার একটি বিদেশি পারফিউম কিনেছি। ’

রাখাইন সম্প্রদায়ের নববর্ষে পরিবারের ছেলে-মেয়েরা যেমনি অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায় থাকে নতুন কাপড়ের জন্য তেমনি বৃদ্ধ বাবা-মাও আশা করেন নতুন কাপড়ের জন্য। কক্সবাজারের রামু উপজেলার হাইটুপি রাখাইন পল্লীর স্কুল শিক্ষিকা মিস খিয়েমে রাখাইন কালের কণ্ঠকে জানান, তিনি নিজে যেমনি নববর্ষে কাপড়-চোপড় নিচ্ছেন তেমনি তার মা-বাবাকেও দিচ্ছেন। মাকে দিচ্ছেন একটি বার্মিজ থামি এবং বাবাকে দিচ্ছেন বার্মিজ লুঙ্গি। শিক্ষিকা খিয়েমে বলেন, ‘আমাদের ঘর-দুয়ার ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে ফেলা হচ্ছে। এটার উদ্দেশ্য হচ্ছে পুরনো গ্লানিকে ধুয়ে ফেলে নতুনকে পাক পবিত্র স্থানে বরণ করে নেওয়া। ’

খিয়েমে রাখাইন জানান, নববর্ষের দিন ঘরে মিষ্টান্নকে সাধারণত প্রাধান্য দেওয়া হয়। বিন্নি চাউলের পিঠা বানানো হয় হরেক রকমের। নুডলস এর খাবার-মুন্ডি হচ্ছে এ সময়ের উত্কৃষ্ট মানের খাবার। বুড়ো-বুড়িরা এ সময় ঘরে মাংসকে একদম না করে দিয়েছেন। প্রায় পরিবারে নিরামিষ খাওয়া হয়। ফুল পূজা ও বাতি পূজা দেওয়া হয়।

খিয়েমে আরো জানান, তাজা ফুলের দরকার নেই। আজকাল বাজারে অভাব নেই প্লাস্টিকের ফুলের। নববর্ষের সময় সব পরিবারেই ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করে নতুনত্ব আনা হয়। তবে অর্থশালী পরিবারগুলো আরো একটু বাড়িয়ে যায়। তাদের ঘরের পর্দা থেকে শুরু করে চেয়ারের কভার ও বেডশিট পর্যন্ত নতুন কিনে লাগানো হয়।

কক্সবাজার বায়তুশশরফ জব্বারিয়া একাডেমির প্রাতশাখার শিক্ষক খিন খিন ছেন রাখাইন জানান, রাখাইন নববর্ষের অনুষ্ঠান চলে সপ্তাহব্যাপী। এবার ১৩ এপ্রিল সকালে কক্সবাজার সরকারি বার্মিজ প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শোভাযাত্রা বের করা হবে। যদিওবা ১২ এপ্রিল নববর্ষ উপলক্ষে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করা হবে বৌদ্ধ মন্দির। শোভাযাত্রায় রাখাইন সম্প্রদায়ের সকল পর্যায়ের ছাত্র-ছাত্রী অংশগ্রহণ করে যাবেন মন্দিরে। তাঁরা সেখানে বুদ্ধ মূর্তিগুলোকে পানি দিয়ে ধুয়ে দেওয়ার কর্মসূচিতে অংশ নেবেন। এভাবে রাখাইন শিক্ষার্থী, নারী এবং সম্মিলিত শোভাযাত্রা তিনদিন ধরেই চলবে।

একই প্রতিষ্ঠানের রাখাইন শিক্ষিকা মাছেন থিং জানান, আগামী শুক্রবার রাখাইন পল্লীর যত রাখাইন নারী রয়েছেন তাঁরা সবাই একটি শোভাযাত্রা নিয়ে যাবেন শহরের অগ্গমেধা টেম্পলে। এ সময় সকল নারী নতুন কাপড় পরবেন। স্বর্ণের অলংকার, মাথার খোঁপা থেকে শুরু করে চমৎকার সাজ নেবেন সবাই। নারীরা সেখানে ভিক্ষুদের দান করবেন এবং মন্দিরে পূজা দেবেন। শোভাযাত্রায় ঢোলবাদক বা ব্যান্ডপার্টিও থাকবে। এভাবে রাখাইন পল্লীর সকল বয়সের নারী-পুরুষেরা মিলেও মন্দিরে নিয়ে যান বিভিন্ন দান সামগ্রী যথা চাল, চিনি, দুধ, কলা, নারিকেল, মোমবাতি দেশলাই। নববর্ষের সময় রাখাইন বয়ষ্ক নারী-পুরুষরা উপবাস করে থাকেন। এ সময় অষ্টশীল পালন করেন সবাই। অর্থাৎ প্রাণী হত্যা, মিথ্যা বলাসহ কমপক্ষে ৮টি দুষ্কর্ম থেকে এ সময় দূরে থাকতে হবে। রাখাইন সমপ্রদায়ের নববর্ষের সপ্তাহব্যাপী অনুষ্ঠানের প্রথম দিন আগামীকাল বৃহস্পতিবার। অনুষ্ঠান দুই পর্বে বিভক্ত। প্রথম পর্বে রয়েছে চার দিনব্যাপী ধর্মীয় অনুষ্ঠান এবং দ্বিতীয় পর্বে তিনদিনের সামাজিক অনুষ্ঠান। আজ বুধবার থেকে ধর্মীয় অনুষ্ঠান শুরু হয়ে ১৬ এপ্রিল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত অনুষ্ঠান চলবে। পরের দিন ১৭ এপ্রিল রাখাইন নববর্ষের ১৩৭৯ মগী সনের প্রথম দিন থেকে ১৯ এপ্রিল পর্যন্ত তিনদিনব্যাপী চলবে রাখাইনদের ঐতিহ্যবাহী জলকেলি অনুষ্ঠান ‘সাংগ্রে পোয়ে’।

কক্সবাজার সিটি কলেজের অধ্যক্ষ ক্য থিং অং রাখাইন জানান, কক্সবাজার  শহরের বিভিন্ন রাখাইন পল্লী যথাক্রমে বায়তুশশরফ সড়ক, টেকপাড়া, মাছবাজার এলাকা, গোলদিঘির পাড়, বৌদ্ধ মন্দির সড়ক, হাঙ্গরপাড়াসহ বেশ কয়েকটি রাখাইন অধ্যুষিত এলাকায় রাখাইন সমপ্রদায়ের লোকজন জলকেলি উৎসব ও পূজা পার্বণের প্রস্তুতি শেষ করেছেন।

বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকতের শহর কক্সবাজারে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী রাখাইনদের নববর্ষ উৎসব প্রতি বছরের মতো এবারও বেশ জাঁকজমকপূর্ণভাবে উদযাপনের প্রস্তুতি নিয়েছেন রাখাইনরা। এ উপলক্ষে কক্সবাজার পৌরসভার ১৭ রাখাইন পাড়ায় চলছে জোর প্রস্তুতি। সেই সাথে মহেশখালী, টেকনাফ, চকরিয়ার হারবাং, রামুর হাইটুপি ও পানেরছড়া, খুরুশকুল ও চৌফলদণ্ডিসহ বিভিন্ন এলাকার রাখাইন পল্লীও সাজছে নতুন সাজে।

কক্সবাজারের বিশিষ্ট রাখাইন গবেষক মংবা রাখাইন বলেন, ‘নববর্ষের এ উৎসবের মূল লক্ষ্য হচ্ছে রাখাইনদের অতীতের সকল ব্যথা-বেদনা, গ্লানি ভুলে গিয়ে ভ্রাতৃত্ববোধের মাধ্যমে ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাওয়া।

নববর্ষে রাখাইন উৎসবে তরুণ-তরুণীরাই সবচেয়ে উৎসবমুখর ভূমিকা রাখেন। এ সময় তাঁরা নতুন কাপড় পরে দল বেঁধে পাড়া-মহল্লা নেচে গেয়ে মাতিয়ে তুলেন। বাদ্য বাজিয়ে নাচ-গানসহ চলে আনন্দঘন অনুষ্ঠান। সাথে ঢাক-ঢোল আর কাঁসার তালে-তালে নেচে উঠবে রাখাইন আবাল-বৃদ্ধ-বনিতাদের প্রাণ। ’

পাঠকের মতামত

জামিনে মুক্তি পেলেন উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়ন চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন, গ্রামে আনন্দের বন্যা

কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এম গফুর উদ্দিন চৌধুরী জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। মঙ্গলবার ...

কক্সবাজার জলবায়ু উদ্বাস্তু পুনর্বাসন প্রকল্প থেকে ৪৪০৯ জনের নাম বাতিল

কক্সবাজারে জলবায়ু উদ্বাস্তু পুনর্বাসন প্রকল্পে (খুরুশকুল) পুনর্বাসনের চার হাজার ৪০৯ জনের তালিকা বাতিল করা হয়েছে। ...